যুক্তরাষ্ট্রের রাটগার্স বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক অ্যালান রোবকের ভারত পাকিস্থানের যুদ্ধ নিয়ে
ভারত-পাকিস্তান পারমাণবিক যুদ্ধের ভয়াবহ পরিণতি লক্ষ লক্ষ মানুষের মৃত্যেু ও বিশ্বব্যাপী মহাদুর্ভিক্ষের শঙ্কা
রাটগার্স বিশ্ববিদ্যালয়ের (Rutgers University) গবেষকদের সহ-অংশীদারিত্বে পরিচালিত একটি সমীক্ষা অনুসারে, ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে পারমাণবিক যুদ্ধ বাঁধলে তাৎক্ষণিকভাবে দশ কোটিরও বেশি মানুষ প্রাণ হারাতে পারে। এর ভয়াবহ পরিণতিতে বিশ্বব্যাপী ব্যাপক খাদ্যাভাব (গণঅনাহার) দেখা দিতে পারে।
রাটগার্স ইউনিভার্সিটি-নিউ ব্রান্সউইকের পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের বিশিষ্ট অধ্যাপক (Distinguished Professor) অ্যালান রোবক বলেন, “এমন যুদ্ধ শুধু সেইসব নির্দিষ্ট স্থানেই বিপদ ডেকে আনবে না যেখানে বোমা ফেলা হতে পারে, বরং এটি সমগ্র বিশ্বের জন্যই চরম হুমকি সৃষ্টি করবে।”
রোবক, যিনি ‘সায়েন্স অ্যাডভান্সেস’ (Science Advances) নামক গবেষণা পত্রিকায় প্রকাশিত এই সমীক্ষার একজন সহ-লেখক, এবং অন্যান্য বিজ্ঞানীরা ২০২৫ সালে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে ঘটতে পারে এমন একটি সম্ভাব্য যুদ্ধের প্রেক্ষাপট বিশ্লেষণ করেছেন। এই প্রতিবেশী দেশ দুটি, যারা উভয়েই কাশ্মীর অঞ্চলের উপর নিজ নিজ আধিপত্য দাবি করে এবং এই ভূখণ্ড নিয়ে একাধিকবার যুদ্ধে লিপ্ত হয়েছে, সেই সময়ের মধ্যে তাদের সম্মিলিত পারমাণবিক অস্ত্রের সংখ্যা ৪০০ থেকে ৫০০-তে পৌঁছাতে পারে। আজও তাদের মধ্যে বিক্ষিপ্ত সংঘর্ষ বা ছোটখাটো লড়াই (skirmishes) অব্যাহত রয়েছে।
গবেষণায় দেখা গেছে যে, পারমাণবিক বোমা বিস্ফোরণের ফলে সৃষ্ট আগুন থেকে ১৬ মিলিয়ন (১ কোটি ৬০ লক্ষ) থেকে ৩৬ মিলিয়ন (৩ কোটি ৬০ লক্ষ) টন পর্যন্ত কালি (ব্ল্যাক কার্বন – black carbon) ধোঁয়ার সঙ্গে নির্গত হতে পারে। এই ধোঁয়া বায়ুমণ্ডলের উপরের স্তরে উঠে যাবে এবং কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়বে।
এই কালি সৌর বিকিরণ (সূর্যের আলো ও তাপ) শোষণ করে নেবে, যার ফলে বাতাস উত্তপ্ত হবে এবং ধোঁয়া আরও দ্রুতগতিতে উপরের দিকে উঠবে। ফলস্বরূপ, পৃথিবীতে সূর্যালোকের পরিমাণ ২০ থেকে ৩৫ শতাংশ কমে যাবে। এতে ভূপৃষ্ঠের তাপমাত্রা ৩.৬ থেকে ৯ ডিগ্রি ফারেনহাইট (২ থেকে ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস) পর্যন্ত শীতল হবে এবং বৃষ্টিপাতের (precipitation) পরিমাণ ১৫ থেকে ৩০ শতাংশ হ্রাস পাবে। এর পাশাপাশি, বিভিন্ন অঞ্চলে আরও ব্যাপক ও далекоপ্রসারী প্রভাব পড়বে।
ভূমিতে গাছপালা ও শস্যের বৃদ্ধি (vegetation growth) ১৫ থেকে ৩০ শতাংশ হ্রাস পাবে এবং সামুদ্রিক উৎপাদনশীলতা (ocean productivity - অর্থাৎ, মাছ ও অন্যান্য জলজ প্রাণের উৎপাদন) ৫ থেকে ১৫ শতাংশ কমে যাবে। এই সমস্ত ক্ষতিকর প্রভাব থেকে স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসতে দশ বছরেরও বেশি সময় লেগে যাবে, কারণ এই বিষাক্ত ধোঁয়া বায়ুমণ্ডলের উপরের স্তরে দীর্ঘকাল অবস্থান করবে।
অধ্যাপক রোবক বলেন, “বর্তমানে বিশ্বের নয়টি দেশের কাছে পারমাণবিক অস্ত্র রয়েছে, কিন্তু পাকিস্তান ও ভারতই একমাত্র দেশ যারা অত্যন্ত দ্রুততার সাথে তাদের অস্ত্রের ভাণ্ডার (arsenals) বাড়িয়ে চলেছে।” তিনি আরও বলেন, “এই দুটি পারমাণবিক শক্তিধর দেশের মধ্যে, বিশেষ করে কাশ্মীর ইস্যুতে, চলমান অস্থিরতার (unrest) কারণে একটি পারমাণবিক যুদ্ধের পরিণতি (consequences) সম্পর্কে আমাদের স্বচ্ছ ধারণা থাকা অত্যন্ত জরুরি।”
গবেষকরা বলছেন, ২০২৫ সাল নাগাদ এই পারমাণবিক অস্ত্রগুলোর বিস্ফোরণ ক্ষমতা ১৫ কিলোটন (kiloton – যা ১৫,০০০ টন টিএনটি অর্থাৎ ট্রাইনাইট্রোটলুইন নামক বিস্ফোরক পদার্থের সমতুল্য এবং ১৯৪৫ সালে জাপানের হিরোশিমায় আমেরিকার ফেলা বোমার সমান) থেকে শুরু করে কয়েকশ’ কিলোটন পর্যন্ত হতে পারে।
যদি ভারত ১০০টি কৌশলগত পারমাণবিক অস্ত্র (strategic weapons – অর্থাৎ যুদ্ধজয়ের জন্য গুরুত্বপূর্ণ বিবেচিত অস্ত্র) এবং পাকিস্তান ১৫০টি এমন অস্ত্র ব্যবহার করে, তাহলে আনুমানিক ৫০ থেকে ১২৫ মিলিয়ন (অর্থাৎ, ৫ কোটি থেকে ১২ কোটি ৫০ লক্ষ) মানুষ সরাসরি বোমা হামলায় মারা যেতে পারে। এর পাশাপাশি, বিশ্বব্যাপী ব্যাপক খাদ্যাভাবের কারণে আরও অসংখ্য মানুষের মৃত্যুর আশঙ্কা থাকবে।
রোবক বলেন, “কোনো যুক্তিসঙ্গত পরিস্থিতিতেই (rational scenario) পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহার করা সমীচীন নয়। কিন্তু দুর্ঘটনা, সাইবার হামলা (hacking – অর্থাৎ, কম্পিউটার নেটওয়ার্ক বা সিস্টেমে অবৈধ অনুপ্রবেশ), চরম আতঙ্ক অথবা কোনো মানসিক বিকারগ্রস্ত (deranged) বিশ্বনেতার হঠকারী সিদ্ধান্তের কারণে এর ব্যবহার ঘটে যেতে পারে।” তিনি জোর দিয়ে বলেন, “এটি প্রতিরোধের একমাত্র উপায় হলো বিশ্ব থেকে পারমাণবিক অস্ত্র সম্পূর্ণ নির্মূল (eliminate) করা।”
রোবক আরও যোগ করেন যে, এই গবেষণার ফলাফল ২০১৭ সালে জাতিসংঘের (United Nations) 'পারমাণবিক অস্ত্র নিষিদ্ধকরণ চুক্তি'র (UN Treaty on the Prohibition of Nuclear Weapons) সপক্ষে আরও শক্তিশালী প্রমাণ দাখিল করে। এই চুক্তির উদ্যোগের স্বীকৃতিস্বরূপ ‘ইন্টারন্যাশনাল ক্যাম্পেইন টু অ্যাবোলিশ নিউক্লিয়ার উইপন্স’ (International Campaign to Abolish Nuclear Weapons) নামক সংস্থাকে ২০১৭ সালে নোবেল শান্তি পুরস্কারে ভূষিত করা হয়েছিল।
বোল্ডারের কলোরাডো বিশ্ববিদ্যালয়ের (University of Colorado, Boulder) বিজ্ঞানীরা এই গবেষণাটি পরিচালনা করেন এবং রাটগার্স বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণা সহযোগী (research associate) লিলি জিয়া (Lili Xia) এতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখেন। অন্যান্য অবদানকারীদের মধ্যে ছিলেন যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল সেন্টার ফর অ্যাটমোস্ফিয়ারিক রিসার্চ (U.S. National Center for Atmospheric Research), ফেডারেশন অফ আমেরিকান সায়েন্টিস্টস (Federation of American Scientists), ন্যাচারাল রিসোর্সেস ডিফেন্স কাউন্সিল (Natural Resources Defense Council), ইউনিভার্সিটি অফ টেক্সাস রিও গ্র্যান্ডে (University of Texas Rio Grande) এবং ইউনিভার্সিটি অফ ক্যালিফোর্নিয়া অ্যাট লস অ্যাঞ্জেলেস (University of California at Los Angeles)-এর বিভিন্ন গবেষকবৃন্দ।
সব মিলবে ডট কমের নিতীমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা যায়
comment url